আলাের দেশ ডেস্ক :
কোনো সংঘাত-সহিংসতা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে সিলেট ও রাজশাহী সিটির ভোটগ্রহণ। এ দুই সিটিতে বিপুল ভোটে সহজ জয় পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। যদিও শুরু থেকে এই চার সিটিতেই নৌকার বিপক্ষে হাল ধরার মতো কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। ফলে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ভোটের ব্যবধানও ছিল ব্যাপক।
সিলেটে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী। প্রকাশিত ফল অনুযায়ী সিলেটে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮২৬ ভোট।
এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবদুল হানিফ কুটু ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ৪ হাজার ২৯৬, মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকে ২ হাজার ৬৪৮ মো. শাহজাহান মিয়া বাস প্রতীকে ২৯ হাজার ৬৮৮ ও মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা হরিণ প্রতীকে ২ হাজার ৯৫৯ এবং জাকের পার্টির প্রার্থী জহিরুল আলম গোলাপ ফুল প্রতীকে ৩ হাজার ৪০৫ পেয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের মেয়রপ্রার্থী হাফিজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান পেয়েছেন ১২ হাজার ৭৯৪ ভোট। এই সিটিতেও ইসলামী আন্দোলনের মেয়রপ্রার্থী হাফিজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান ভোট বর্জন করেন। এই সিটিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নৌকা ও লাঙ্গল প্রার্থীর মধ্যে। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল সাংবাদিকদের বলেন, এটা পাতানো নির্বাচন ছিল। আমার কোনো এজেন্টকে কেন্দ্রে থাকতে দেওয়া হয়নি।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সাল কাদের বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি ফল অনুযায়ী, রাজশাহীতে নৌকার প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন পেয়েছেন ৯ হাজার ৪৫৭ ভোট। গোলাপফুল প্রতীক নিয়ে ইসলামী জাকের পার্টির প্রার্থী লতিফ আনোয়ার পেয়েছেন ১১ হাজার ৫৮৪ ভোট। হাতপাখার প্রার্থী মুরশীদ ফারুকী পেয়েছেন ১৩ হাজার ৩৯৩ ভোট। যদিও বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করিমের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেষ সময়ে এসে নির্বাচন বর্জন করেন মুরশীদ ফারুকী। এই চার প্রার্থীর মধ্যে হেভিওয়েট নৌকার প্রার্থী ও সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন।
সিলেট : বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ইভিএমে চলে ভোটগ্রহণ। ভোটগ্রহণের সময় বিকাল ৪টা পর্যন্ত থাকলেও কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন থাকায় ৪টার পরেও ভোট নেওয়া হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর আগে সকাল ৭টা থেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ভোটাররা। ইভিএমে ভোট দেওয়া নিয়ে এক ধরনের কৌতূহল কাজ করেছিল তরুণ ভোটারদের মধ্যে। উৎসাহ-উদ্দীপনায় নারী-পুরুষ ভোটাররা তাদের ভোট প্রদান করেন। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
সকাল ৮টায় পাঠানটুলা জামেয়া কেন্দ্র্রে ভোট দিয়ে নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। সকাল ৯টায় আনন্দ নিকেতন স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিয়ে নির্বাচনে পেশিশক্তির প্রয়োগ করার অভিযোগ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। অন্য প্রার্থীরা নিজ নিজ কেন্দ্রে ভোট প্রদান করেন। অন্যদিকে ভোটকে কেন্দ্র করে সিলেটজুড়ে ছিল প্রশাসনের কঠোর নজরদারি। শেষ পর্যন্ত কোথাও কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।
এবারের সিসিক নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ১৯০টি। এর মধ্যে ১৩২ কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এবার বর্ধিত এলাকাসহ মোট ৪২ ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৩ জন ও নারী ভোটার রয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৪ জন। ঝুঁঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ১৬ জন সদস্য ছিলেন। ভোটকেন্দ্রের বাইরেও ছিল বিশেষ নিরাপত্তা বলয়।
যা বলছে ইসি : ভোটের দিন সকাল ৮টা থেকে রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে স্থাপিত সিসি ক্যামেরার মনিটরিং কন্ট্রোল রুম থেকে দুই সিটির ভোট পর্যবেক্ষণ করে ইসি। এ সময় কন্ট্রোল রুমে উপস্থিত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর। ইসি জানায়, সিলেট সিটিতে ৩ হাজার ২০৪টি এবং রাজশাহীতে ২ হাজার ৫০০টি ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। আর সিলেটে ১ হাজার ৭৪৭টি সিসি এবং রাজশাহীতে ১ হাজার ৪৬৩টি সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে কমিশন। ভোট শুরুর দুই ঘণ্টা পরপর সাংবাদিকদের ভোটের পরিস্থিতি জানায় ইসি।
ভোট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে উৎসাহিত করবে। কেননা পাঁচটি সিটি নির্বাচন ভালো হয়েছে। আমরা দিনভর নির্বাচন মনিটরিং করেছি। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, আনন্দমুখর পরিবেশ সম্পন্ন হয়েছে। আধাঘণ্টা প্রবল বৃষ্টির কারণে কিছুটা ব্যাঘাত হলেও ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন হয়েছে। আমরা যে কারণে সন্তুষ্ট বোধ করছি, কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যেটা নির্বাচনে প্রত্যাশা থাকে, ভোটার অবাধে এসে ভোট দিতে পারেন কি না সেই প্রশ্নে আমরা বলব, তারা এসেছেন। অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার খবর আমরা পাইনি। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে নজর রাখছিলাম।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে আনুমানিক ৫২-৫৫ শতাংশ উপস্থিত হয়েছেন। সিলেটে কম-বেশি ৪৬ শতাংশ উপস্থিতি ছিল বলে জানতে পেরেছি। কিছুটা হেরফের হতে পারে। বাসাইল পৌরসভা নির্বাচনও ভালো হয়েছে। সেখানে ৭০ শতাংশ ভোটার উপস্থিত ছিলেন। শতভাগ ভোট কখনোই নিশ্চিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও শতভাগ ভোট পড়ে না। ৫০ শতাংশ ভোট গুড এনাফ। ৬০-৭০ শতাংশ হলে এক্সিলেন্ট। আমরা চেষ্টা করে যাব।
রাজশাহী সিটিতে এক নারী বারবার গোপনকক্ষে প্রবেশ করায় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সেটা আমরা তদন্ত করব। সিসি ক্যামেরায় আমরা দেখেছি একজন নারী একাধিকবার ভেতরে যাচ্ছেন। পরে জানতে পেরেছি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট তাকে তিন দিনের সাজা দিয়েছেন। এটা একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে, যে ম্যালপ্র্যাকটিসের জন্য সাজা হতে পারে। তবে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দেখলেন না কেন, আমরা সেটা তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
দিনভর যেমন ছিল দুই সিটি নির্বাচন
রাজশাহী : বুধবার সকাল ৮টা থেকে ইভিএমে শুরু হয় রাজশাহী সিটির ভোটগ্রহণ যা চলে বিকাল ৪টা পর্যন্তু। কিন্তু সকাল ৭টা থেকেই নগরীর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। রাজশাহীতে এবারই প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। তাই অনেকের মধ্যে ছিল বাড়তি আগ্রহ। কিন্তু বেলা ১১টায় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে বিপাকে পড়েন ভোটারা। ফলে ৪০ মিনিট ধরে কেন্দ্রে ভোট দিতে পারেনি তারা। বৃষ্টি থামলে ধীরে ধীরে আবারও কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে থাকে।
সকাল ৯টার দিকে নগরীর স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল কেন্দ্রে স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ ভোট দেন নৌকার প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট চলছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে সমস্যা হয়েছে। সেগুলো রিপ্লেস করা হচ্ছে বলে ইসি জানিয়েছে।
সকাল ১০টার দিকে নগরীর আটকোষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন লাঙ্গলের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন। এ সময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ইভিএমে ঘণ্টায় ১৩-১৪টা ভোট হচ্ছে। শত শত মানুষ গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ভোট নিতে নিতে ইভিএম অচল হয়ে যাচ্ছে। মেশিন যদি অচলই হয়ে যাবে তা হলে এগুলো আনল কেন? ১০ দিন আগে প্রস্তুতি নেয়নি কেন? এই নির্বাচন কমিশন একটা অপদার্থ।
দুপুর ১২টায় ১০ নং ওয়ার্ডের হেতমখাঁ গোরস্থান এলাকার মুসলিম হাই স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন জাকের পার্টির মেয়রপ্রার্থী লতিফ আনোয়ার। ভোট দিয়ে তিনি বলেন, আমি সরকার ও দেশের জনগণকে বিশ্বাস করি তাই কোথাও পোলিং এজেন্ট দেইনি। তার মানে এই নয় যে আমাদের জাকের পার্টি নরম, দুর্বল। আমাদের সারা দেশের প্রচুর সমর্থক ও কর্মী আছে।
আর হাতপাখার প্রার্থী মুরশিদ ফারুকী জানান, নির্বাচনে নিজের ভোট দিতেও যাননি তিনি। তাই এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান না। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজশাহী সিটি নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। পুরো এলাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ভোটকেন্দ্রগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিল ১ হাজার ৫৬০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন থেকে সিসি ক্যামেরায় রাজশাহী ও সিলেট সিটি ভোট পর্যবেক্ষণের এক পর্যায় কমিশন দেখে যে, একজন মহিলা একাধিকবার মহিলা ভোটারদের নিয়ে গোপন কক্ষে প্রবেশ করছেন। এরপর কমিশনাররা প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে তিন দিনের জেল দিয়ে দেন। রাজশাহী সিটির ২৮ নং ওয়ার্ডেও ১৪১ নং কেন্দ্রে তালাইমারী দারুল উলুম আলিম মাদরাসার নিচতলায় এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ভোট চলাকালে দুপুর ১টার দিকে নগরীর ৪ নং ওয়ার্ডের কেশবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের বাইরে ‘টিফিন ক্যারিয়ার’ প্রতীকের প্রার্থী রুহুল আমিন টুনু ও ‘র্যাকেট’ প্রতীকের প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম বাবুর সমর্থকদের মধ্যে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
রাসিক নির্বাচনে মোট ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৮০ হাজার ৮০৯ জন ও পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ১৬৭ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৬ জন। এবার নতুন ভোটারের সংখ্যা ৩০ হাজার ১৫৭ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ১৫৫টি। নির্বাচনে চারজন মেয়রপ্রার্থী, ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১১১ জন কাউন্সিলর প্রার্থী ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৪৬ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থীসহ মোট ১৫৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।