সোহাগ রাসিফ
করোনাভাইরাস মহামারীতে সমগ্র বিশ্বের ন্যয় বাংলাদেশও স্থবির হয়ে আছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যেমন বেহাল দশা তেমনি শিক্ষাকার্যক্রমও থমকে আছে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের নয় দিন পর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় সরকার। চার মাসের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ আছে। কবে খুলে দেওয়া সম্ভব, তা বলতে পারেনা কেউ-ই। দীর্ঘসময় ক্লাস পরীক্ষার বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীরা মানুষিকভাবে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
একাডেমিকভাবে শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পরা চিন্তা করে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ অনলাইনে একাডেমিক কর্যক্রম চালু করে। এই দূর্যোগকালীন সময়ে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা গিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনলাইনে ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে উপযোগী ডিভাইস (স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ, ইন্টরনেট) থাকা প্রয়োজন। উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট ও দূর্বল গতির ইন্টারনেট অর্থাৎ ইন্টারনেটের অপ্রাপ্যতাই অনলাইন পাঠদানে শিক্ষার্থীদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাড়িয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রায় সকল শিক্ষার্থীরা তাদের গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন, অনেকের বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানে তারা ওয়াইফাই ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে না, মোবাইলে উচ্চমূল্য দিয়ে ডাটা কিনেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হচ্ছে। কেউ নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস করুক কিংবা ফেইসবুক-ইউটিউব থেকে ক্লাস লেকচারের ভিডিও-রেকর্ড ডাউনলোড করুক, তার মাসিক ইন্টারনেট বিল মিনিমাম হাজার টাকা লাগবেই। যা একটা দরিদ্র পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়৷
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দেশের এমন ক্রান্তিকালে এই পরিবারগুলো যখন তাদের মৌলিক খরচ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে সেখানে ইন্টারনেটের খরচ বহন করা তাদের উপরে বাড়তি অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ তৈরি করা ছাড়া কিছু নয়। তাদের অনলাইনে ক্লাস করাটা এক ধরনের বিলাসিতা। যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি ও পার্ট টাইম জব করে নিজেদের খরচ বহন করতো করোনা দূর্যোগে তাদের আয়ের উৎসও এখন বন্ধ।
দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে যদি বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ কিংবা সরকারের পক্ষ হতে সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট খরচে সহায়তা প্রদান করলে কিংবা মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলোর সাথে সরকার সমন্নয় করে ইন্টারনেট খরচ কমিয়ে আনা গেলে এই মহামারীতেও শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় এগিয়ে যাবে, শিক্ষাকার্যক্রমও সুষ্ঠুভাবে চলবে এবং মহামারী পরবর্তী সময়ে শিক্ষাখাতের ক্ষতিটা সহজেই পুষিয়ে নিতে পারবে।
১৪ মে বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহর করছেন ৯ কোটি ৫১ লাখ ৬৮ হাজার গ্রাহক। দেশে সীমিত সংখ্যক (৪ টি) মোবাইল ফোন অপারেটর থাকায় অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছেন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। এর জন্য মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের মূল্য কমছেনা। এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে মোবাইল ফোনের সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট , ১ শতাংশ সারচার্জ, ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য কর মিলে মোট কর ৩৩.২৫ শতাংশে দাড়াল। যেহেতু করোনার দূর্যোগে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ন ইন্টারনেট নির্ভর। সুতরাং ইন্টারনেটের এমন মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভুগী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
এবার আসা যাক দূর্বল গতির ইন্টারনেটের বিষয়ে। অনেকের বাড়ি শহর থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত অ লে। যেখানে ইন্টরনেটের নেটওয়ার্ক ভালভাবে পৌছায় না। যার ফলে অনেকে বাড়ির ছাদে, দুরে খোলা মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে ক্লাস করতে হচ্ছে। দুর্বল নেটওয়ার্কের কারনে অনেকে ক্লাসই জয়েন করতে পারছে না। ঠিকমত এটেইনডেন্স পাচ্ছে না। বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, ক্লাসের অডিও ভিডিও ভালোভাবে বুঝা যাচ্ছে না, ফলে পাঠিত বিষয়টিতে এবারেই মনোযোগ রাখা যায় না। গানিতিক তথ্যনির্ভর কিংবা ব্যাবহারিক ক্লাসগুলো অনলাইনে করাটা কষ্টকর। সরকার আগে ‘ইন্টারনেটের অপ্রাপ্যতা’ সমাধান করে তারপর ‘অনলাইনে পাঠদান’ চিন্তা করা উচিৎ।
লেখক: সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
ই-মেইল : sohagrasif@gmail.com